মৃত্তিকাশ : অন্তিম পর্ব
সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠেই মোহনা গোসল সেরে আসে। রাতে বৃদ্ধ দম্পতির সাথে দেখা করার পর নীলাদ্র আরো কিছু দেখাবে বলেছিল। কিন্তু মোহনা সাঁয় দেয়নি। ঘুমের দোহাই দিয়ে চলে এসেছে। এসেই চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়েছে।
ইশতিয়া কল করেছে সকাল সকাল। মোহনা কল ধরেই শরীরের কথা জিজ্ঞেস করল। ইশতিয়া খুব অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও মেয়েকে কিছু বলল না। সময় গড়াতে গড়াতে এগারোটা বাজে। নীলাদ্র মোহনাকে বলল,' সময় নেই আমার সাথে। চলো কিছু দেখাব তোমাকে।'
মৃত্তিকাশ : অন্তিম পর্ব |
মোহনাও রাজি হয়। তারা দুজন মিলে ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে হাঁটতে থাকে। বিভিন্ন জনকে তাদের দাম্পত্য জীবন নিয়ে জিজ্ঞেস করে। এক পর্যায়ে দেখতে পায় গলির মোড়ে একটি টং দোকানে এক দম্পতি চা বিক্রি করছে। মহিলাটি চা বানাচ্ছে আর লোকটি সেটা বিতরণ করছে বিস্কুটের সাথে। নীলাদ্র মোহনাকে সেদিকে দেখতে বলে। মোহনা দেখল একসাথে তারা কত খুশি। মধ্যবয়সী হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে কত কেয়ার, কত ভালোবাসা। তারা হেসে খেলে কাজ করছে। একে অন্যকে সাহায্য করছে। অনেকটা সময় গড়িয়ে যায় তাই তারা দুপুরের খাবার খেতে বসে একসাথে। মহিলাটি তার স্বামীকে নিজে হাতে খাইয়ে দিচ্ছে। লোকটিও তার ক্লান্ত বউকে খাইয়ে দিচ্ছে।
এসব দেখে মোহনা বলল,' আমি বাড়ি যাব এখনই। আমার ভালো লাগছে না।'
নীলাদ্র আর কিছু বলল না। বাড়িতে চলে গেল।
বিয়ের নিয়ম অনুসারে মোহনাকে আজ তার বাপের বাড়ি যেতে হবে। তাই সন্ধ্যায় রওনা দেয়।
পৌঁছানোর সাথে সাথেই ইশতিয়া খুব খুশি। মেয়েকে বক্ষে জড়িয়ে ধরে পরম আবেশে। জিয়াওল কথা বলে নীলাদ্রর সাথে। মোহনার সাথে কথা বলতে আসলে সে সরে যায়। নীলাদ্র তাকে তার বাবার সাথে কথা বলতে বলে। মোহনা জিয়াওলকে শুনিয়েই বলল,' ওনি কখনো কারো বাবা হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। আমি ওনাকে ঘৃণা করি। আমার মায়ের সাথে দেখা করা শেষ এবার আমাকে নিয়ে চলুন। আমি আর থাকতে চাই না এখানে।'
নীলাদ্র ওকে আড়ালে নিয়ে বলল,' এত মানুষের সামনে এসব কি বলছ তুমি? বিয়ে দিয়েছে এটা তার দায়িত্ব। তুমি না চাইলেও তোমাকে এটা করতে হত।'
' উঁহু, ভুল করছেন। ওনি চাইলেই আমি শান্তিমত বাঁচতে পারতাম, পড়াশোনা করতে পারতাম। ওনি যদি সবাইকে বলতেন ওনার মেয়েকে ওনি অনেক পড়াতে চান কেউ যেন বিরক্ত না করে তাহলে কেউ আমার বিয়ে নিয়ে কথা বলত না। পরিবারের সাপোর্টের কারণেই হাজার হাজার মেয়ে সাবলম্বী হচ্ছে।'
নীলাদ্র কিছু বলার মত পেল না। মোহনার কথাটা ফেলে দেওয়ার মত না। কথাটা একদম খাঁটি।
রাত হতেই মোহনার আরো বিরক্ত লাগতে শুরু করে। নীলাদ্রর সাথে বার বার রাগ দেখাতে থাকে। কিছু ভালো লাগছে না ওর। উপায় না পেয়ে নীলাদ্র মোহনার খাবারে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দেয়। এর কারণে খুব শিঘ্রই ঘুমিয়ে যায়।
পরদিন সকাল সকাল মোহনা জোর করেই নীলাদ্রকে নিয়ে চলে গেল। সন্ধ্যায় মোহনা বসে ছিল ছাদে। বাড়ির বউ সন্ধ্যায় ছাদে বসে আছে দেখে মোহনার শাশুড়ি নীলাদ্রকে বলল তাকে ডেকে আনতে।
নীলাদ্র ছাদে যেতেই দেখল মোহনা একমনে তাকিয়ে আছে দুরে। কাছে গিয়ে নীলাদ্র ডাকতেই হুঁশ ফেরে। মোহনাও তাড়াহুড়ো করে নামতে যায়। নামতে গিয়ে চোখ যায় দুটো বেড়ালের উপর। নীলাদ্র খেয়াল করে বলল,' দেখো, কত মিষ্টি বেড়ালছানা।'
' কিন্তু আমার পছন্দ না। আমি বেড়াল, কু'কুর পছন্দ করি না।'
' আমি পছন্দের কথা বলিনি। খেয়াল করে দেখো তারা একসাথে। তুমি জানো, এরা দু'বছর একসাথে আছে। তাদের খু'নসু"টি দেখেই বিকেলের সময় কাটাই আমি। তারাও একে অপরকে ভালোবাসে। তারা কিন্তু তোমার বাবার মত না।'
মোহনা কোনো কথা না বলে চলে যায়। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সে। নীলাদ্র চিন্তায় আছে।
আর মাত্র একদিন আছে, এর মাঝে যদি মোহনার ধারণা ভুল প্রমাণিত না হয় তাহলে সে মোহনাকে হারিয়ে ফেলবে। এসব ভাবতে ভাবতেই সে বারান্দায় দোলনাতেই ঘুমিয়ে পড়ে।
পরদিন সকাল হতেই মোহনা গোছগাছ শুরু করে। তার উদ্দেশ্য বেরিয়ে যাবে। কিছু একটা কাজ জোগাড় করে নেবে। নীলাদ্র এসব দেখে চোখ কপালে তুলে বলল,' এসব কি? কোথায় যাচ্ছ?'
' চলে যাব। চাকরি করব তারপর মাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাব।'
' চারিদিকের অবস্থা জানো? চারিদিকে হায়নার দল ওঁৎ পেতে আছে। একা একটা মেয়ে হয়ে কি করবে তুমি? এখানে কাউকে চেনো? জেদ করো কেন?'
' আপনি আমার ওপর এত অধিকার ফলাবেন না। আমি আপনার কেউ না। আপনাদের মত ছেলেদের আমি ঘৃণা করি।'
' কোথায় যাবে শুনি?'
' আপনাকে বলতে যাব কেন?'
' আরো ষোলো ঘন্টা বাকি আছে। এর আগে কোথাও যাবে না।'
মোহনাও দমে যায়। নীলাদ্র বলল,' চলো বাইরে ঘুরতে যাই।'
মোহনাও রাজি হয়ে যায়। তারা একটা ফুচকা দোকানে যায়। নীলাদ্র এসব পছন্দ করে না। তবুও মোহনার জন্য নিজেও খেতে বসল। এক পর্যায়ে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল,' আচ্ছা ভাই, আপনি এত কষ্ট করে রোজগার করেন কেন?'
দোকানদার মনে হলো কোনো জোকস শুনল, হেসে বলল,' কি কন ভাই? পোলা, মাইয়া আর বউয়ের লাইগ্গাই রোজগার করি। আর কি জীবনের মানে। বউ, পোলাপানের শান্তির জন্যই করি। তারা শান্তি থাকলেই আমি শান্তি।'
' বউকে খুব ভালোবাসেন?'
' হ ভাই। ভালোবাসা ছাড়া কি আর সংসার টিকে?'
মোহনা কিছু খাবে না বলে এখান থেকে ওঠে যায়। নীলাদ্র আর কাউকে জিজ্ঞেস করেনি কিছু। সারাদিন ঘোরাফেরা করে। মোহনাও নিজের মত উপভোগ করছে। যদিও ঠোঁটে এক চিলতেও হাসি নেই।
সন্ধ্যায় আসতেই নীলাদ্রর বাবার হার্টের ব্যথা শুরু হয়। তার মা কেঁদে একাকার। তাড়াতাড়ি হাসপাতাল নেওয়া হয়। মোহনা দেখল তার শশুর একটু ভালো হতেই শাশুড়ি ছুটে যায়। গ্লাসের ফাঁক দিয়ে মোহনা দেখল তার শশুর শাশুড়ির ভালোবাসা। তারা একে অপরকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
এমন সময় মোহনা সরে যেতেই দেখল তার পেছনে নীলাদ্র দাঁড়িয়ে আছে। নীলাদ্র ওকে উদ্দেশ্য করে বলল,' আমার শেষ প্রমাণ এটা। তবে একটু পর বলব, আগে বাবাকে বাড়ি নিই, এখন ওনি সুস্থ আছেন।'
রাত বারোটা বাজে। একটা বাজলেই তিনদিন শেষ হবে। মোহনা কোমর পর্যন্ত কাঁথা জড়িয়ে শুয়ে আছে। নীলাদ্র ওর পাশে এসে বসল। সাথে সাথেই মোহনা ওঠে গেল। নীলাদ্র বলল,' আমার বাবা মা হলো আমার শেষ প্রমাণ। এরপর তোমার যা ইচ্ছা সিদ্ধান্ত।'
মোহনা কিছু বলল না। নীলাদ্র বলল,' মাকে যে সুস্থ দেখছ তা একমাত্র বাবার জন্যই!'
মোহনা অবাক হয়ে বলল,' মানে?'
' দু'মাস আগে মায়ের দুইটা কিডনিই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মৃ'ত্যু পথযাত্রী ছিল মা। আর তখন বাবা নিজের একটা কিডনি মাকে দিয়ে দেয়। তারা শপথ করেছিল বাঁচলে একসাথে বাঁচবে, মরলে একসাথে মরবে। তাইতো বাবা নিজের কিডনি দিতেও দ্বিধা করেনি। ভালোবাসার জন্য নিজের প্রাণ বললেও আমার বাবা মা একে অপরের জন্য দিতে রাজি।'
মোহনা বুঝতে পারছে না তার কি বলা উচিত। ভালোবাসা এমনও হয়? তা তার জানা ছিল না। সেতো স্বামী স্ত্রী মানেই জানতো তার বাবা মায়ের মত। যেখানে একজন পুরুষ অকথ্য অত্যা'চার করবে নারীর উপর। অন্যজন লোকল'জ্জার ভয়ে তার সাথে সংসার করে যাবে মুখ বুজে।
মোহনা পূর্ণ দৃষ্টি দিল নীলাদ্রের ওপর। এই তিনদিনে একবারও ভালো লাগার দৃষ্টিতে দেখেনি সে। আজ তাকাল। দেখেই কেমন ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। নীলাদ্র চোখে মুখে বিষন্নতা আর ভালোবাসা মেলে ধরে তাকিয়ে আছে। মোহনা চোখ সরাতে গিয়েও সরায় না। দুজন দুজনকে প্রাণ ভরে দেখতে থাকে।
কিছু সময় যাওয়ার পর মোহনা বলল,' আপনি কি আমার বাবার মত নাকি আপনার বাবার মত?'
নীলাদ্র হেসে বলে,' আমি আমার মত। তুমি কি আমাকে গ্রহণ করবে? কথা দিলাম যে কষ্ট এতদিন বয়েছিলে তার সূচ পরিমাণও পেতে দেব না।'
' যদি আপনি পরিবর্তন হয়ে যান?'
' ওটা ভাবার কারণ নেই। যদিও আমি কখনো পরিবর্তন হব না তবুও তোমাকে আমি এমনভাবে গড়ে তুলব যেন নিজেকে তোমার অবলা মনে না হয়। তুমি পড়াশোনা করবে। নিজের পায়ে দাঁড়াবে। আমি হব তোমার শিক্ষক।তোমার মায়ের শিক্ষা নেই বলে সে অবহেলিত হয়েছে। তুমি সেটা হবে না। তুমি শিক্ষিত হবে, চাকরি করবে কিনা তোমার ব্যাপার। তবে নিজেকে তুমি এই সমাজের যোগ্য করে তুলবে।'
মোহনা একটু ভেবে বলল,' আমার ভাইয়ের পাশাপাশি আপনাকেও আমার ভালো লাগে।'
নীলাদ্রর চোখ ঝিলিক মেরে ওঠে। মোহনা বলেছিল তার ভাই ছাড়া আর কোনো পুরুষকেই সে কখনো দেখেনি ভালো করে। নীলাদ্রের ইচ্ছে করছিল মোহনাকে একবারের জন্য জড়িয়ে ধরে এই সময়টাকে স্মরণীয় করে রাখতে। কিন্তু সামলে নিয়ে বলল,' তোমার মায়ের কষ্ট পেতে হত না যদি শা'লা বাবু তোমার বড় হত। তুমিতো সবার মুরব্বি তাই না?'
মোহনা হেসে ওঠে। বলল,'বাবা কেন এমন হলো? ওনার কখনোই আমাদের উপর মায়া হয়নি। সমাজের টানাপোড়েনে আমাকেও বলি করল। যেন ওনি মুক্তি পেয়ে গেলেন।'
নীলাদ্র বাকরুদ্ধ! এমন বাবাও আছে বুঝি? এত নিষ্ঠুর বাবাও হয়? হ্যাঁ হয়! আমাদের সমাজের আনাচে কানাচে এমন অনেক বাবা আছেন যারা নিজেদের দায়িত্ব ভুলে যায়। যারা স্ত্রী বলতে শুধু সন্তান জন্ম দেওয়ার খোরাক আর ব্যবহারের ঠুনকো জিনিস মনে করে। তারা কখনো ভালোবাসা বুঝে না। তারা বুঝে না প্রেমের গভীরতা।
মোহনার বুকের ভেতর জমানো কষ্টগুলো যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে। নীলাদ্র তাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করছে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। কিন্তু বার বার হাত বাড়িয়েও সরিয়ে নিয়ে আসছে। মোহনা নিজে থেকেই বলল,' আমার কষ্ট হচ্ছে, আমাকে জড়িয়ে ধরুন।'
কথাটা নীলাদ্রের কাছে মেঘ না চাইতেই জল বলে মনে হলো। এক ঝটকায় মোহনাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়। সাথে সাথেই মোহনা তাকে ধা'ক্কা মেরে খাট থেকে ফেলে দেয়। কোমরে ব্যথা পেয়ে নীলাদ্র বলল,' এমন করলে কেন?'
মোহনার শরীর কাঁপছিল। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,' আমার সুড়সুড়ি লাগছিল, আপনার শরীর খুব গরম আর...'
নীলাদ্র কোনরকমে ওঠে এসে বলল,' আর কি?'
' আমার জানা নেই। কিছু একটা...'
' সেটা কি? আমার স্পর্শ কি তোমার খারাপ লাগছিল?'
' উঁহু,, খারাপ লাগেনি তবে সহ্য হচ্ছিল না।'
'মানে?'
' আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল যেন। আপনি আমাকে আর কখনো ছুঁবেন না। মনে থাকে যেন।'
' এটা কেমন কথা। বিয়ে করেছি, বউকে ছুঁব না কেন?'
' এটা আমার আদেশ। গুড নাইট!'
বলতে না বলতেই মোহনা ঘুমিয়ে পড়েছে। নীলাদ্র নিজের চুল খামচে ধরে। বাপ্পারাজের পুরনো একটা গান প্লে করে শুনতে থাকে। খাটে থাকা মোহনার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করল,' আমার কি তাহলে বাসর হবে না?'
~ সমাপ্ত
(গল্পটা কেমন হলো বলে যাবে কিন্তু। আবারো কোনো মৃত্তিকাশের মায়া নিয়ে হাজির হব ইনশা'আল্লাহ 🦋)
0 মন্তব্যসমূহ