দ্বিতীয় পর্ব: ০২
সাজানো হলো মোহনাকে। এক প্রকার জোর করেই তাকে বিয়ের জন্য নিয়ে যাওয়া হলো। মোহনার বার বার মাথা চক্কর দিচ্ছিল। বিয়েতো নয়, মনে হচ্ছে কেউ তাকে ফাঁ'সি দিতে নিয়ে যাচ্ছে। ভাবী তাকে নিয়ে যাওয়ার সময় কোনোদিকে না তাকিয়ে বাড়ির সদর দরজা বরাবর দৌড় দিল। কিন্তু পারেনি দরজা পার হতে। দেখল সামনে বর বেশে দাঁড়িয়ে আছে নীলাদ্র। মোহনা সামনে পিছনে তাকিয়ে পা বাড়াতেই নীলাদ্রর বুকের সাথে ধা'ক্কা খায়।
মৃত্তিকাশ : দ্বিতীয় পর্ব: ০২ |
মৃদু হেসে দরজার সাথে লেপ্টে দাঁড়াল, উঁহু, বিয়ে শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোথাও যাওয়া নিষেধ।
ইউ চিটার! যা ইচ্ছা বলুন। সমস্যা নেই। কিন্তু বিয়ে আপনাকে করতেই হবে। মোহনা আর উপায় না পেয়ে সুড়সুড় করে গিয়ে বসে যায়। মনে মনে বলল, বিয়েতো করব আমি, কিন্তু পরে দেখবে কেমন লাগে? বিয়ের সখ মিটিয়ে দেব নীলাদ্রর বাচ্চা নীলাদ্র। খচ্চ'র, খবিশ ছেলে।
যথানিয়মে বিয়ে করে নেয় মোহনা। আর একটাও কথা বারায়নি। মেয়েকে বিদায় দেওয়ার সময় ইশতিয়া খুব কান্না করে। মোহনার চোখেও জল নেমে আসে। মাকে ধরে অঝোরে কেঁদে ওঠে। সবকিছু কেমন বিষাদময় লাগছে ওর কাছে। জিয়াওল যখন এগিয়ে আসে মোহনার দিকে তখনই দু'কদম পিছিয়ে যায় মোহনা। নীলাদ্রকে বলল, আমাকে নিয়ে চলুন। আমি এখানে আর এক মুহূর্তও থাকতে চাই না। জিয়াওল ওকে কয়েকবার আটকানোর চেষ্টা করে একটু কথা বলার জন্য। কিন্তু সে অবজ্ঞা করে নিজে নিজেই গাড়িতে ওঠে বসে। মায়ের দিকে তাকাতেই বুকটা খাঁ খাঁ করে ওঠে। কান্না যেন বাঁধ মানছে না।
নতুন বউয়ের এমন আচরণ দেখে বরপক্ষ অবাক। জিয়াওল বলল, মেয়েটা ছোট, বুদ্ধি হয়নি এখনো। রাগ করেছে অনেক তাই আরকি। কিছু মনে করবেন না।
সবাই বিদায় নিয়ে বউ নিয়ে চলে গেল। অল্প সময়ের আয়োজনে নীলাদ্রের বাড়িতে অনেক আয়োজন করা হয়েছে।
মোহনা ঘরে একা একা বসে আছে লম্বা ঘোমটা টেনে। বিরক্ত লাগছে ভীষণ কিন্তু কিছু করার নেই। একটু পরই দরজায় আওয়াজ হলো। মোহনা বুঝতে পারল নীলাদ্র এসেছে। তাই কোনো সাউন্ড না করে চুপচাপ বসে থাকে। মনে মনে তাকে গালি দিতে থাকে অগণিত।
নীলাদ্র এসেই গ্লাস থেকে পানি খেল। তারপর খাটের উপর গিয়ে বসল। মৃদু হেসে মোহনার ঘোমটা সরাতেই মোহনা একখানা ছু'রি বের করে তার গলা বরাবর ধরে বলল, খবরদার ছুঁতেও আসবেন না। না হয় মে'রে এখানেই কব'র দিয়ে যাব।
নীলাদ্র হেসে ওঠে। মোহনা অবাক হয়ে বলল, হাসছেন কেন? ছু'রি দেখে কি ভয় করছে না? ভাবছেন আমি আপনাকে আঘা'ত করতে পারব না! তাইতো? ভুল ভাবছেন, আমার সাহস সম্পর্কে আপনার ধারণা নেই।
নীলাদ্র তবুও হাসছে। মোহনা রাগে ফেটে পড়ে, একদম চুপ! হাসলে এবার ঠোঁটগুলোও কে'টে দেব একদম।
একটা ফল কা'টার ছু'রি দিয়ে আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন মিসেস নীলাদ্র? এটা হাস্যকর! আপনি যে এটা আপনার বাড়ি থেকে এনেছেন সেটাও জানি আমি। এমন উদ্ভট কান্ড ঘটাবেন সেটাও জানি। সব খেয়াল রেখেছিলাম আমি।
আমার খুব রাগ হচ্ছে। এত রাগ আমি কোথায় রাখব? আপনাকে আমি... মোহনা নীলাদ্রর গলা চেপে ধরে।
নীলাদ্র কোনোরকমে বলল, ভয় পেয়ো না, আমি তোমার ওপর কোনো অধিকার দেখাব না। তোমার মা আমাকে আগেই বলেছে কেন তুমি বিয়ে করতে চাও না? আর এটাও জানি আমাকেও তুমি কখনো স্বামীরুপে গ্রহণ করবে না। খুব শিঘ্রই আমাদের ডিভোর্স হতে চলেছে। আমি কখনোই তোমার থেকে ভালোবাসা নামক জিনিসটা পাব না।
মোহনা অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়, আপনি সব জেনে আমাকে বিয়ে করেছেন?
হুম, আমার মনে হয়েছে সমাজের ঘ্লানি থেকে তোমাকে রক্ষা করা এবং তোমার মাথায় থাকা বাজে ধারণাকে মুছে দেওয়া।
আমার ধারণা মানে? আপনাকে মা সব বলে দিয়েছে?
একদম সব বলেছে। তারপর আমি নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিয়ে করব তোমাকে। আর বুঝিয়ে দেব আকাশ আর মাটির মধ্যে ঠিক কি পার্থক্য! আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন কেন? আপনি করে বলুন। দুঃখিত! তুমি আমার আইনত বউ, তাই তুমি করেই বলব। তুমি করে বললে ভালোবাসা বাড়ে।
দিবাস্বপ্নে দেখছেন? ঘড়িতে দেখো! এখন দিন না রাত, আমি রাতের স্বপ্নই দেখছি। আপনাকে আমার বিরক্ত লাগে।
লাগবেই, কারণ ছেলেদের নিয়েইতো একটা বড় ধারণা ধরে আছ! আমি চাই তোমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হোক। তার আগেই আমি চলে যাব এই বাড়ি থেকে।
কোথায় যাবে? যেখানে দু চোখ যায় সেখানে যাব তবুও আপনার কাছে থাকব না।
নীলাদ্র কিছু বলল না। সে জানে কষ্ট থেকে মেয়েটা এমন বলছে। নীলাদ্র একপাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
মোহনা অবাক হয়ে বলল, আমি কোথায় শোঁব?
আমার বুকে।'
ল'জ্জা সরম চাঙ্গে তুলেছেন নাকি?
নীলাদ্র এক লাফে ওঠে যায়, বলল, আচ্ছা, আমি যদি তোমার সব ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিই তাহলে কি তুমি আমাকে ভালোবাসবে?
পারবেন না। আঠারো বছরের জীবনের অভিজ্ঞতা, কিভাবে মুছে দেবেন ক্ষতগুলো? এতদিনে জমা হওয়া কষ্ট কি করে একদিনে মুছে দেবেন? আদৌ কি কোনো উপায় আছে?
আছে! আমার কাছে আছে! তিনদিন সময় দাও। এই তিনদিনে আমি তোমার সব ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করতে পারব ইনশা'আল্লাহ। এর জন্য তোমাকে আমার সাথে থাকতে হবে, আমার কথামত আমার সাথে যেতে হবে।
কোথায় যাব? চলো আমার সাথে, এখন থেকেই বাহাত্তর ঘন্টা পরে তুমি সিদ্ধান্ত নেবে আমার সাথে বাকি জীবন থাকবে কিনা? আমি তখন আর জোর করব না। ওকে ডান।
মোহনা কখনো বিয়ে করতে চাইত না তার পরিবারকে দেখে। ছোট থেকেই দেখে আসছে জিয়াওল তার মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করে। এমন কোনো দিন নেই যেদিন ইশতিয়ার গায়ে হাত তোলেনি। খাবার একটু বাজে হলে সেদিন ইশতিয়ার খাওয়া বন্ধ করে দিত। একটা রান্না বাজে হলে আরো দশটা রান্না করাতো। রমজানে সারারাতই রান্নাঘরে থাকতে হত ইশতিয়াকে।
কারণ জিয়াওল হাজারটা রকমারী রান্না করতে বলতো। এর মাঝে একটা খাবার একটু খারাপ হলে মারধর করতো। ইশতিয়ার পুরো শরীরে মারের দাগ ছাড়া কিছুই নেই। সামান্য জিনিস নিয়েও ইশতিয়ার বাবা মা নিয়ে কথা তুলতো জিয়াওল। জিয়াওলের মুখের ভাষা অত্যন্ত বি'চ্ছিরি।
স্ত্রী ছাড়া, মেয়ের সাথেও বাজে ভাষা ব্যবহার করত। বড় একজন বিজনেসম্যান হয়েও সে কখনো মেয়েকে একটা জামা কিনে দেয়নি। কখনো অসুস্থ হলে গিয়ে একবারও জিজ্ঞেস করেনি কেমন আছে মেয়েটা! কখনো তার পড়াশোনার জন্য দুপয়সাও দেয়নি।
ইশতিয়া তার বাপের বাড়ি থেকে কিছুটা এনে মেয়েকে সামলাতো, তার প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দিত। এটা দেখেও জিয়াওল খুব মারতো। সে নিজেও খেয়াল রাখবে না মেয়ের, একটা জামা কিনে দেবে না কখনো আবার কেউ সাহায্য করতে এলেও তাকে বিদায় করে দেবে বি'চ্ছিরি গালিগালাজ করে। সবাই তাকে সাইকো বলে।
সমাজের ভয়ে মেয়েটাকে বিয়ে দিতে চাইছে। নতুবা টাকা শেষ হয়ে যাওয়ার ভয়ে এটাও করত না। স্কুল পড়ুয়া মেয়ে মোহনা। কি আর করতে পারে মায়ের জন্য। আসার সময় কেঁদেছিল কারণ অনেকদিন ধরে ইশতিয়ার বুকের ব্যথাটা দেখা দিয়েছে। কিন্তু জিয়াওল ডাক্তার দেখায়নি। এই অবস্থাতেও অকথ্য অত্যা'চার করেছে।
অসুস্থ মাকে একা রেখে আসতে পারছিল না মোহনা। তাই ছোট থেকেই শপথ নিয়েছে কখনো সে বিয়ে করবে না। একজন ভালো মানুষ হয়ে মাকে একটা সুন্দর জীবন দেবে। কিন্তু হলো না। এর আগেই বলি হয়ে গেল।
কেঁদে ওঠে মোহনা। নীলাদ্র হঠাৎ তার কান্না দেখে বিচলিত হয়ে যায়। তারা রাস্তার কিনারায় হাঁটছিল। নীলাদ্র মোহনাকে নিয়ে বেড়িয়েছে। কান্না জড়িত মুখ দেখে তার খুব মায়া হয়। রুমাল এগিয়ে দিয়ে বলল, আমরা এসে গেছি।
বলেই একটা ছোট কুঁড়েঘরে ঢুকল। দরজায় করা'ঘাত করতেই এক বৃদ্ধ লোক বেড়িয়ে এলো। নীলাদ্রকে এত রাতে দেখে চমকিত সে। তার বৃদ্ধা গিন্নিকে ডেকে বলল, আ জামির মা, দেহো কেউগা আইছে! মোহনা দেখল দুজন বৃদ্ধ বৃদ্ধা ছাড়া আর কেউ নেই। তারা একাই থাকে এখানে।
নীলাদ্র জিজ্ঞেস করল, দাদা, এত রাতে বিরক্ত করলাম, কিছু মনে করবেন না। আমার বউ আপনাদের দেখতে চেয়েছে তাই নিয়ে এলাম। বৃদ্ধা খুশি হয়ে তাড়াতাড়ি বাতাশা দিল দম্পতিকে। মোহনা বুঝতে পারছে না কেন তারা এখানে এসেছে।
বৃদ্ধা বলল, তা নাতি ভালা করছস। আমার জামি, আমিরেরতো মেলা কাজ, মা বাপরে দেহনেও সময় নাই। তুই মাঝে মাঝে আইয়া মনডারে শান্তি দেস।
মোহনা বুঝতে পারল বৃদ্ধার ছেলে মেয়েরা তাদের দেখে না, তাই একা থাকে এখানে। নীলাদ্র বলল, দাদি, আমার বউ আমাকে ভালোবাসে না। তুমি কি বলবে কি করলে বউ ভালোবাসবে?
বৃদ্ধা হেসে বলল, বাসবো, বাসবো, সময় লাগবো। দুইদিনে এই পিরিতি অয় না। আমাগো বিয়ের সময় আমার বয়স ছিল আট। কিছু বুঝতাম না, খালি মারতাম তোর দাদারে। হেয় আমারে আদর করত। দিন যাইতে যাইতে এহন পিরিতি বাড়ছে। তাইতো সত্তর বছর একলগে আছি।
সত্তর বছর একসাথে? তোমাদের কি কখনো ঝগড়া হত না?
তা হইবো না ক্যা। কত ঝগড়া করতাম, পরে আবার মিলে যাইতাম। তোর দাদার আমারে ছাড়া ঘুম হইত না, তয় যত রাগ করি না ক্যান রাগ ভাঙ্গাই নিত। মোহনার চোখ ছলছল করে ওঠে। কত ভালোবাসা এই বৃদ্ধ দম্পতির মাঝে।
নীলাদ্র বলল, দাদা আপনি কি করে দাদির রাগ ভাঙাতেন?
দাদা রস করে বলে, বুড়ির রাগ নাই, জড়াই ধরলেই কোনো রাগ থাহে না। মিলে যাই শেষ বয়সে কেউ লগে নাই, দুইজন দুইজনের খেয়াল রাইখাই আছি, আর কি রাগ করমু ক?
নীলাদ্র কিছুটা বাতাশা মুখে পুরে নিয়ে বলল, এভাবেই থাকবেন আজীবন। আমি মাঝে মাঝে দেখতে আসব। শরীরের যত্ন নেবেন। বলেই পকেট থেকে কিছু টাকা চুপিচুপি বৃদ্ধার হাতে দিয়ে দিল।
মোহনার মনটা উষ্ণ এখন। বার বার ভাবছে, ভালোবেসে ঐ দম্পতি সত্তর বছর একসাথে। কতটা ভালোবাসা থাকলে এমনটা হয়। ভাবতে ভাবতেই সে হারিয়ে যায় ভাবনার শহরে। নীলাদ্রের কথায় ধ্যান ভাঙ্গে। বিদায় নিয়ে তারা নিরালায় হাঁটে।
নীলাদ্র বলল, চলো এবার পরের প্রমাণের পালা। এখান থেকে যা বুঝেছ তাই এনাফ।
চলবে... মৃত্তিকাশ: তৃতীয় পর্ব- সমাপ্ত
মৃত্তিকাশ | সাথী ইসলাম
0 মন্তব্যসমূহ