প্রথম পর্ব - ০১
মেয়ে মানুষের এত দেমাগ দেখাতে নেই। পরিবার যা বলে, চোখ বন্ধ করে মেনে নিতে হয়। আর মুখের উপর কথা বলিস না বিয়েটা এবার করে নে মা। সমাজে যে আর মুখ দেখানো যাবে না।
বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরিয়ে মোহনা বলল,' কেন? মেয়েরা কোন দিক দিয়ে পচে গেছে? কেন মেয়েদের সব মেনে নিতে হবে? কেন সমাজে মুখ দেখানো যাবে না? কি এমন অন্যায় করেছে মেয়েরা?'
' মুখে মুখে তর্ক করিস না। ছেলে লাখে একটা। সিঙ্গাপুর থেকে এসেছে। এমন ছেলে হাতছাড়া করতে পারি না। অনেক টাকা পয়সাও আছে। তুই খেয়ে শেষ করতে পারবি না।'
কোনো কথা না বলে ওঠে চলে গেল মোহনা। ভালো লাগছে না এসব শুনতে।
মৃত্তিকাশ |
সকালে শুনতে পেল পাশের বাসার আন্টির গলা। একটু কান দিতেই শুনতে পায়,' তা ভাবী, মেয়ের কি সমস্যা আছে নাকি? এতগুলো ছেলে দেখাল, বিয়ে হলোনা। আমার মেয়েকেতো প্রথম দেখাতেই পছন্দ করেছে। বিয়েও হয়েছে ভালো ঘরে।'
মোহনার মা ইশতিয়া খানম বলছে,' মেয়েটা বিয়ে করতে চায় না, পড়াশোনা করতে চায়। তাই আরকি।'
' ওমা সেকি কথা? উনিশে পা দিল, দুইদিন পর কুড়িতে পা দেবে। মেয়ে মানুষ কুড়িতেই বুড়ি। খোঁজ নিয়ে দেখুন, হয়তো কারো সাথে ইটিশ ফিটিশ চলছে। মেয়ের দিকে নজর দেওয়া উচিত আপনাদের। ভাইকে কাল বললাম। পরে পস্তাতে হবে দেখে নিয়েন। মেয়ে হয়ত পালানোর চিন্তা করছে।'
'এমন কিছু না ভাবী।'
'থাক আর বলতে হবে না। চরিত্রে কালি লাগলে বুঝবে কেমন লাগে। মেয়েকে লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলছেন, কয়দিন পর দেখবেন আপনাদের মুখে চুন কালি দিয়ে কোনো ছেলের সাথে পালিয়েছে। আজকালকার ছেলেমেয়েদের বিশ্বাস নেই। কখন কি করে বসে।'
' আমার মেয়ে এমনটা করবে না কখনো। আমার ওর প্রতি বিশ্বাস আছে। ভালো করে বুঝালেই রাজি হয়ে যাবে।'
' যাই করেন, তারাতাড়ি করেন। রাস্তাঘাটে চলাফেরা করে চোখ কান খোলে গেছে। ছেলেদের সাথে চলাফেরা করে। খারাপ হয়ে গেছে মেয়ে। কয়দিন পর বংশের মুখে কালি দেবে, তাই সিদ্ধান্ত নেন।'
এসব কথা মোহনা সহ্য করতে পারল না। রেগেমেগে গেল সেখানে। মহিলাটি মোহনাকে দেখে বলল,' আসিগো এখন, অনেক কাজ বাকি।'
ইশতিয়া মোহনার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই বলল, 'ছেলের পক্ষ দেখতে আসবে আজকে। কিছু উল্টা পাল্টা বলিস না আগের মত। সবাই তোকে নিয়ে কথা বলছে। কয়েক মাস ধরেই আমি লোকসমাজের কথা শুনছি। এভাবে চললে তোর আর কখনোই বিয়ে হবে না। কোনো কূল হবে না। আল্লাহর দোহাই লাগে রাজি হয়ে যা।'
ভেতরটা পুড়ছিল মোহনার। তীব্র এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো গহীন থেকে। কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। হু হু করে উঠল বুকের ভেতরটা।
Jobspost365 |
কিছুক্ষণ পর ইশতিয়া আবার এসে বলল তৈরি হতে, কিছু্ক্ষণের মধ্যেই পাত্রপক্ষ এসে যাবে। বলতে না বলতেই এসে হাজির। কি করবে এখন মোহনা? পাশের ঘর থেকে ভাবী এসে বলল,' দেখতে আসলেই বিয়ে হয়ে যায় না। কিছু হবে না, তৈরি হয়ে যাও।'
ভাবী শাড়ি পরিয়ে সাজিয়ে দিল মোহনাকে। সাজ বলতে হালকা লিপস্টিক আর খোলা চুল।
পাত্রপক্ষের সম্মুখে যেতেই চোখ ফেটে জল নেমে এলো মোহনার। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নেয়। মোহনা জানে বিয়েটা ঠিক হয়েই যাবে, কারণ আগেই তারা ছবি দেখে পছন্দ করেছে। দিন তারিখ সব ঠিক করেও নিয়েছে জিয়াওল খানমের সাথে। এখন শুধু লোক দেখানো সাক্ষাৎ করতে এসেছে। তবুও শেষ আশা হিসেবে গেল মোহনা। ভেবেছে কিছু একটা করবে অন্তত।
পাত্রের নাম নীলাদ্র। নীলাদ্র আর মোহনাকে আলাদা কথা বলার জন্য পাঠানো হয় ছাদে। সুযোগ পেয়েছে ভেবে মোহনাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। নীলাদ্র লজ্জা পাচ্ছে। মুখে জড়তার জন্য তেমন কিছু জিজ্ঞেস করল না কয়েক মিনিট। মোহনা বলেই ফেলল,' আমাকে একটা সাহায্য করবেন?'
মৃদু হেসে নীলাদ্র বলল,' বলুন।'
' আপনি সবাইকে গিয়ে বলুন, আপনার আমাকে পছন্দ হয়নি। আপনি বিয়ে করতে চান না আমাকে।'
তার মধ্যে কোনো ভাব দেখা গেল না, বলল,' বয়ফ্রেন্ড আছে?'
' জন্মগত সিঙ্গেল আমি।'
' তাহলে কেন বিয়ে করতে চান না?'
' আমি পড়াশোনা করতে চাই। আরো কত কাজ বাকি এখনো।'
' আমি বলিনি বিয়ের পর পড়াশোনা করতে পারবেন না। আপনার বাবার সাথে আগেই কথা হয়েছে এ নিয়ে, ওনি বলেছেন আপনার পড়ার প্রতি খুব আগ্রহ। তাই আমিও চাই আপনি বিয়ের পরেও পড়াশোনা চালিয়ে যান।'
' কিন্তু তবুও আমি বিয়ে করতে চাই না।'
' আর কোনো রিজন আছে কি? আপনার কি আমাকে পছন্দ হয়নি?
' বিয়ে করতেই চাই না। পছন্দের কথা এখানে আসছে না। পছন্দের কথাটা তখনই আসবে যখন আমি বিয়ে করতে চাইব।'
' নিশ্চয় আপনার কারো সাথে রিলেশন আছে। আপনি আমাকে বলতে পারেন, আমি আপনাকে সাহায্য করব। আপনার বাবাকে বুঝিয়ে বলব।'
' উঁহু! আমার কখনো কোনো ছেলেকেই ভালো লাগেনি, রিলেশন করা দূরে থাক।'
' তাহলে বিয়ে করতে না পারার একটা কারণ বলুন। কেন আপনি আমাকে রিজেক্ট করছেন সেটা জানার ষোলো আনা অধিকার নিশ্চয় আমার আছে।'
' উফফ্! এতকিছু বলতে পারব না আমি। বিয়ে করতে চাই না ব্যাস।
' কারণ না বললে আমি কোনটা বুঝে ডিসিশন নেব?'
কিছুক্ষণ ভেবে মোহনা বলল,' কারণ আমি নিজেও জানি না। বিয়ের কথা শুনলেই আমার খুব কান্না পায়। মনে হয় কেউ সুই'সাইড করার আদেশ করছে।'
' আপনার মা আগেই বলেছে আপনি এখনো বাচ্চা মেয়ে, লম্বা হয়ে গেছেন এখনো মাথায় বুদ্ধি হয়নি। ওনি আমাকে আগেই সতর্ক করেছেন, আপনি এসব অদ্ভুত কথা বলবেন।'
' কিইই! মা সব আগে থেকে বলে দিল? একদম ঠিক করেনি।'
' আপনি হয়তো জানেন না আপনার জন্য কতটা চিন্তা করে আপনার মা বাবা। আপনার ভালোর জন্যই তারা আপনার বিয়ে দিতে চায়।'
' বিয়ে করলে আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে।'
'কোনো স্বপ্ন শেষ হবে না। আমি কথা দিলাম সবসময় সাথে থাকব। আপনার স্বপ্নগুলো নিজের বলে পূরণ করব।'
' তাও হবে না। বিয়ে মানেই অন্যের উপর নিজের ভার ছেড়ে দেওয়া। কিছুদিন পর আপনার আমাকে বোঝা মনে হবে। আমি আগে নিজের সব স্বপ্ন পূরণ করব তারপর বিয়ে।'
' সত্যি করে বলুন আপনার কি অন্য কাউকে পছন্দ?'
মোহনার খুব রাগ হলো। কাঠকাঠ গলায় বলল,' আজ পর্যন্ত কোনো ছেলের দিকে আমি ঐরকম দৃষ্টিতে তাকিয়েও দেখিনি। কখনো ভালো লাগার মত দৃষ্টি না দিলে কিভাবে কাউকে পছন্দ থাকতে পারে? একমাত্র আমার ভাই ছাড়া আর সব ছেলেকে আমার একই মনে হয়। আমি তাদের আলাদা করে শনাক্ত করতে পারিনা। ভালো লাগা আসেনা কারো প্রতি।'
' আমার প্রতিও না?'
' আমি আপনাকে এখনো খেয়াল করিনি সেভাবে।'
' তাহলে ভালো লাগবে কি করে? কারো প্রতি ভালোলাগা আনতে হলে প্রথমত তাকে দেখতে হয় মন দিয়ে।'
'আমার আপনার সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে না। দয়া করে নিচে গিয়ে বলবেন আপনার আমাকে পছন্দ হয়নি, তাহলেই হবে। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ!'
নীলাদ্র কিছু বলল না। নিচে নেমে যাওয়ার আগে বলল,' কিছু কি বলবেন না? আমি কিন্তু আপনার বন্ধু হয়ে থাকতে চাই, স্বামী নয়।'
' কিছু বলার নেই। আমার কখনো বিয়ে করতে ইচ্ছে করেনা। ইচ্ছে করবেও না কখনো। জীবনে কোনোদিন বিয়ে করব না। মানবতার ফেরিওয়ালা হয়ে থাকব আজীবন।'
নীলাদ্র মোহনার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে পুনরায় বলল,' সেটা আপনি আমার সাথেও করতে পারেন। আমরা না হয় একসাথেই সব করব।'
' উঁহু! পারব না।'
নীলাদ্র নিচে নেমে গেল। জিয়াওলকে কিছু বলতে যাবে, তখনি ইশতিয়া তাকে ডেকে নিয়ে গেল নিজের ঘরে।
এসেই নীলাভ্র সহ সবাই বিয়েতে রাজী। তারা দেরী করবে না। আজকেই বিয়ে।
মোহনার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। কিছুতেই সে বিয়ে করবে না। কিন্তু কেউতো তার কথা কানেও তুলছে না। কি করবে এখন?
চলবে.... মৃত্তিকাশ : দ্বিতীয় পর্ব- ০২
মৃত্তিকাশ | সাথী ইসলাম
0 মন্তব্যসমূহ